বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ছিনতাই-চাঁদাবাজির পাশাপাশি মারামারি-খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে এলাকাভিত্তিক বখাটে কিশোর-তরুণরা। মাদকাসক্ত এসব কিশোরকে ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক নেতারাও। সামাজিক নানা অপকর্মে লিপ্ত কিশোর-যুবাদের নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এলাকাভিত্তিক নেতা ও সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় এসব বখাটের উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক শিক্ষা না থাকায় কিশোররা এ ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। রাজনৈতিক নেতার প্রশ্রয়ে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। মূলত সমাজ এবং পরিবার বিচ্ছিন্ন ছিন্নমূল কিশোররা স্বাভাবিক শৈশব না পেয়ে অপরাধী হয়ে ওঠছে। পুলিশ বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে মাদক সহজলভ্য না হওয়ায় চুরি-ছিনতাইয়ে নেমেছে তারা।
চট্টগ্রামে পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, কিশোর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি তাদের আচরণ সংশোধনেরও কাজ করছি আমরা। আটক করার পর দেখা গেছে, অনেকেরই সুন্দর শৈশব নেই। আমরা চেষ্টা করছি তারা যেন অপরাধজনক কাজ থেকে ফিরে এসে একটি সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন পায়।
জানা গেছে, গত ২৮ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত নগরীর ফ্লাইওভারের আশপাশে অভিযান চালিয়ে ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র?্যাব-পুলিশ। এর অধিকাংশই শিশু-কিশোর। তাদের কাছে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত ছুরি, রড ও সুতা পাওয়া গেছে। মূলত নেশার টাকা জোগাড় করতে পাঁচ থেকে ছয়জনের দলে ভাগ হয়ে ছিনতাই করে। ‘ড্যান্ডি’ সেবন করে তারা।
সূত্র জানায়, নগরীর দুই নম্বর গেট, জিইসি, জাকির হোসেন রোড, আলফালাহ গলি ও নাসিরাবাদ এলাকায় সক্রিয় শুলকবহর ওয়ার্ডের কথিত যুবলীগ নেতা সোলাইমান বাদশার গ্যাং। তার গ্রুপের সদস্যরাই ফ্লাইওভারসহ আশপাশের এলাকায় চুরি-ছিনতাই করছে। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা হলেনÑ মো. ফারুক, মো. শামীম ওরফে ব্লেড শামীম, আইমান জিহাদ, খোকন চৌধুরী, তানজিল করিম খান মাহীর, মাঈনুদ্দিন ফরিদ রাকিব, মোহাম্মদ জুবায়ের হোসেন প্রত্যয় ও বখাটে আবদুল হাকিম অভি।
এ গ্রুপের সদস্যরা ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দুই পক্ষের বিরোধের জের ধরে কিলিং মিশনে যাওয়ার পথে পুলিশ চেকপোস্টে থামানোর জের ধরে পুলিশের এক এএসআইকে গুলি করে। এ ছাড়া প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসিম আহমদ সোহেল হত্যায়ও জড়িত এ গ্রুপের সদস্যরা।
নগরীর বায়েজিদ থানা এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ সব অপরাধেই সামনের সারিতে থাকে কিশোর অপরাধীরা। তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে এলাকাভিত্তিক একাধিক বড়ভাই। এসব বড়ভাই নিজেদের ‘নিয়ন্ত্রিত’ এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহার করেন ছোটদের। বড় ভাইয়েরা এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে অন্যের জমি দখল করে দেওয়ার কাজও করান কিশোরদের দিয়ে।
বায়েজিদ এলাকার কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণকারীরা হলোÑ মোহাম্মদ দুলাল প্রকাশ লাল দুলাল, মো. জাবেদ প্রকাশ ডিস জাবেদ, মফিজ আলম, তানভীর, বাবলু, সোহেল প্রকাশ গুটি সোহেল, সালাউদ্দিন। এদের মধ্যে দুলাল ও জাবেদের নেতৃত্বে বাংলাবাজার এলাকায় বড় একটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। তাদের ‘নিয়ন্ত্রিত’ এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয় কিশোর অপরাধীদের। কিশোর গ্যাং লিডার দুলাল যুবলীগ নেতা মেহেদী হাসান বাদল হত্যা মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে থানায় রয়েছে একাধিক মামলা।
নগরীর বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ মাদকের দুষ্প্রাপ্যতা। সহজে মাদক না পাওয়া এবং দাম বৃদ্ধির কারণে টাকা জোগাড় করতে ছিনাইয়ের দিকে ঝুঁকছে।
সম্প্রতি গ্রেপ্তার ৪৪ জনের মধ্যে ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। ১ আগস্ট রাত থেকে ২ আগস্ট বিকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া জানান, ২১ জনের মধ্যে পাঁচজন কিশোর। বাকিদের অধিকাংশই যুবক। আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নিচে এবং ওপরে নির্জন স্থানে বসে মাদকসেবন করে। সন্ধ্যার পর অন্ধকার সেতুতে লোকজনকে অহেতুক বিরক্ত করে। তারা ছোটখাট ছিনতাইয়েও জড়িত থাকতে পারে।
নগরের সিআরবি, কদমতলী, আমবাগান, টাইগারপাস এলাকায় সক্রিয় বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমনের নেতৃত্বে একটি গ্যাং। ২০১৩ সালের ২৪ জুন নগরের সিআরবিতে কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে বাবর গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষে শিশুসহ দুজন খুন হয়। এ মামলার আসামি লিমন। তার গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে রেলওয়ের টেন্ডারবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগ রয়েছে।
Leave a Reply